কোনো দেশে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন নিছক রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, এটি একটি গভীর ও সময়সন্ধির মুহূর্ত। ইতিহাস বলছে, এ ধরনের পতনের পর রাষ্ট্রগুলো সাধারণত প্রবেশ করে এক নতুন বাস্তবতায়, যাকে বলা হয় ‘ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী যুগ’ অথবা ‘উত্তর-ফ্যাসিবাদ অধ্যায়’। এই পর্বে একটি রাষ্ট্র সাধারণত তিনটি সম্ভাব্য পথে অগ্রসর হতে পারে—১. রাষ্ট্রটি আগের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে পারে, যেখানে গৃহযুদ্ধ, সহিংসতা বা চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ২. রাষ্ট্রে পুরোনো ফ্যাসিবাদী মানসিকতা ও কাঠামোর ধারাবাহিকতা বজায় থাকতে পারে। ৩. অথবা রাষ্ট্র একটি ইতিবাচক, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিস্ট শাসনের পতনের পর দেশটি প্রথম ও সবচেয়ে ভয়াবহ সম্ভাবনাটি থেকে রক্ষা পেয়েছে, মানে দেশে গৃহযুদ্ধ হয়নি, বৃহৎ সহিংসতা বা দাঙ্গা ছড়ায়নি, যা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক।
এখন বাংলাদেশের সামনে রয়েছে দুটি স্পষ্ট পথ—এক. দেশটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক একটি ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাবে; অথবা দুই. নতুন চেহারায় আবারও ফ্যাসিবাদ ফিরে আসবে, যা হয়তো হবে আগের চেয়েও চতুর ও কৌশলী।
তবে জনগণ চায় এমনভাবে রাষ্ট্র গড়ে উঠুক, যেখানে তাদের মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলোকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হবে এবং ফ্যাসিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে না। এই আকাঙ্ক্ষা কোনো অবাস্তবতায় আবৃত কল্পনাপ্রসূত নয়। এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবসম্মত এবং বাস্তবায়নযোগ্য, যা তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও মানবাধিকার সম্পর্কে গভীর ধারণার প্রতিফলন। সভা, সেমিনার, টিভি টকশো, পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে জনগণ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম স্পষ্টভাবে কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ সম্পর্কে বারবার নিজেদের ধারণা তুলে ধরছে এবং ব্যাখ্যা করছে।
তারা তুলে ধরছে কী ধরনের সমৃদ্ধ, ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ তারা দেখতে চায়। যদিও বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়মিত জনমত জরিপ (সার্ভে) খুব একটা হয় না, তবুও বিভিন্ন পত্রিকা, টিভি চ্যানেলে এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রতিনিয়তই বর্তমান সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা ধরনের জরিপ, মতামত ও আলোচনা হয়। এই জনমত বা গণপ্রতিক্রিয়াগুলো বিশ্লেষণ করলে মোটা দাগে নাগরিকদের যে রাষ্ট্রচিন্তা ও আকাঙ্ক্ষার রূপরেখা পাওয়া যায়, তা হলো—
১. বাংলাদেশের জনগণ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম প্রত্যাশা করে, ফ্যাসিবাদী সরকার ও এর সহযোগী দল ছাড়া সব রাজনৈতিক দল জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধভাবে বর্তমান সরকারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে, যাতে সরকার কাঙ্ক্ষিত সংস্কার বাস্তবায়ন ও গণঅভ্যুত্থানের সময়সহ বিগত ১৭ বছরে ফ্যাসিবাদী শাসনকালে সংগঠিত অপরাধগুলোর স্বচ্ছ বিচার সম্পন্ন করতে পারে। তরুণ সমাজ এই বিচারকে প্রতিশোধ নয়, বরং গণতান্ত্রিক শুদ্ধিকরণের অংশ হিসেবে দেখে। আর সংস্কারকে দেখে রাজনীতির নতুন বন্দোবস্ত হিসেবে, যেখানে জনগণ নাগরিক হয়ে উঠতে পারবে।
২. বিদেশি বিশেষ করে ভারতীয় আধিপত্য থেকে এদেশের মানুষ মুক্তি পেতে চায়। তাদের বিশ্বাস, ভারতীয় প্রভাব কমে গেলে দেশের অনেক সমস্যা বিশেষ করে রাজনৈতিক সংকট আপনা-আপনিই অনেকটা দূর হবে। কারণ ভারত গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এদেশের রাজনীতিকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের মানুষ চায়, কোনো রাজনৈতিক দল যেন আর ভারতের সমর্থন বা আনুকূল্য নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা না করে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যেন ভারতের আধিপত্যমুক্ত হয়, সেজন্য জনগণ মিডিয়া ক্যাম্পেইন করছে অবিরত। ‘ভারতমুক্ত রাজনৈতিক দল চাই’ এমন ক্যাম্পেইন সোশ্যাল মিডিয়ায় চলমান, যেখানে লাখ লাখ মানুষ অংশ নিচ্ছে। তারা আশা করে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতসহ সব প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে এমন একটি সম্মানজনক সম্পর্ক গড়ে উঠুক, যেখানে থাকবে সমতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা; কিন্তু কোনো একতরফা প্রভাব বা আধিপত্য থাকবে না।
৩. জনগণের প্রত্যাশা, সক্রিয় সব রাজনৈতিক দল নিজ দলে প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চা করবে। কারণ কোনো রাজনৈতিক দল যদি নিজেরাই গণতন্ত্র চর্চা না করে, তাহলে রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে জনগণকে গণতন্ত্র উপহার দিতে পারবে না। দল বড় বা ছোট যে রকমই হোক, জনগণ চায় নেতাকর্মীদের ওপর যেন দলটির কার্যকর নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং কেউ দলীয় পরিচয়ে অপরাধ করে পার না পায়। অপরাধ সংঘটিত হলে দল যেন লোকদেখানো নয়, বরং দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
কারণ বাংলাদেশের জনগণ বহু বছর ধরে দেখছে, তাদের ভোটে নির্বাচিত অনেক নেতা অর্থপাচার, চাঁদাবাজি, ঘুষ, জবরদখল, হত্যা, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত। বিশেষ করে গত ১৭ বছরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একটি মাফিয়াতন্ত্রের উত্থান ঘটেছিল। তাই তারা আশা করে, রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের এই বার্তা উপলব্ধি করে নেতৃত্ব নির্বাচনে সঠিক ভূমিকা পালন করবে। এই প্রত্যাশাকে সামনে রেখে ‘গবেট নেতামুক্ত দল চাই’ শীর্ষক একটি সামাজিক ক্যাম্পেইন চলমান, যেখানে লক্ষাধিক মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে। এ থেকেই স্পষ্ট, জনগণ এখন সত্যিকারের নৈতিক ও জবাবদিহিমূলক রাজনীতি চায়।
৪. বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৭ শতাংশের বয়স ২৯ বছরের নিচে। এই বিশাল জনগোষ্ঠী এমন নেতৃত্ব প্রত্যাশা করে, যাদের সঙ্গে তাদের বয়সের ব্যবধান থাকবে খুবই কম। কারণ তাদের বিশ্বাস, অনেক প্রবীণ নেতা তরুণদের ভবিষ্যৎ চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারেন না। প্রযুক্তির যুগে বেড়ে ওঠা এই নতুন প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা, চিন্তাধারা ও চ্যালেঞ্জগুলো ৬০ বছরের বেশি বয়সি নেতাদের থেকে অনেকটাই ভিন্ন। তাই তারা আশা করে এমন নেতৃত্ব, যারা তাদের চিন্তা-ভাবনা ও প্রেক্ষাপটকে গভীরভাবে বুঝতে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে সক্ষম।
এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের জনগণ এমন একটি সরকার পেয়েছে, যার নেতৃত্বে আছেন নোবেলবিজয়ী ও বিশ্বখ্যাত ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত কয়েক মাসে জনগণ নেতৃত্বাধীন সরকার থেকে যে ধরনের নাগরিক মর্যাদা এবং সেবা পেয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের প্রত্যাশার বাইরে ছিল। কারণ যুগের পর যুগ তারা এমন মর্যাদা ও সেবা/সুবিধা পায়নি। এজন্য জনগণ ভবিষ্যতেও এমন একজন শাসক চাইবে, যিনি যথেষ্ট যোগ্য এবং তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারবেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশের ইমেজকে আন্তর্জাতিকভাবে আরো উজ্জ্বল করতে সক্ষম হবেন।
জনগণের এই স্পষ্ট আকাঙ্ক্ষাকে কোনো রাজনৈতিক দল যদি ধারণ না করে, অথবা উপেক্ষা করে, অথবা আমলে না নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়, তাহলে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার রাস্তা হবে খুবই কঠিন, এমনকি কোনোভাবে ক্ষমতায় গেলেও টিকে থাকা কঠিন হবে। এর দুটি কারণ আছে—১. দেশের জনগণ জানে কীভাবে গণঅভ্যুত্থান করে শক্তিশালী ও ভয়ংকর স্বৈরশাসককে ক্ষমতাচ্যুত করতে হয় এবং ২. তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো আন্তর্জাতিক মানের একজন নেতা পাওয়ার যোগ্য তারা। তাই জনগণ যদি ড. ইউনূসের মতো বা তার কাছাকাছি মানের কোনো নেতা ভবিষ্যতে না পান এবং কোনো রাজনৈতিক দল যদি স্বৈরাচার হয়ে ওঠে বা উঠতে চায়, তা হলে জনগণ ওই দলকেও আওয়ামী লীগের মতো উৎখাত করবে।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, উল্টোটা করতে গেলে মুখে শুধু কালি পড়ে। ঠিক তেমনি জনগণের আকাঙ্ক্ষা রাজনৈতিক দল ধারণ করবে, কিন্তু তারা যদি সেটা না করে দলের আকাঙ্ক্ষা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়, তা হলে তাদের মুখেও কালি পড়বে, মানে উৎখাত হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ
ম্যাকনিজ স্টেট ইউনিভার্সিটি
লুইসিয়ানা, ইউএসএ